মহামারী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বে কৌতূহল ব্যাপক। এরই মধ্যে নানা দেশে এর প্রয়োগও শুরু হয়েছে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ সরকারও।
দেশে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও পরিকল্পনা নিয়ে নানামুখী কাজ শুরু হয়েছে। দেশে চার ধাপে টিকা বিতরণের জন্য একটি খসড়া পরিকল্পনাও হয়েছে।
কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির অন্যতম সদস্য ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা বিষয়ে একটি প্রাথমিক খসড়া শেষ করা হয়েছে।
খসড়া পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি ধাপে টিকা বিতরণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে দুই ধাপে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
প্রথম ধাপে দেশের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ অর্থাৎ ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবেন। আর দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকা পাবেন, বলে জানান এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে দুই ধাপে বিতরণ শেষে দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের টিকা দেওয়া শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন টিকা পাবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র অনুযায়ী, দেশে টিকা বিতরণের খসড়া পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে টিকা দেওয়া হবে এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জনকে। প্রথম পর্যায়ের ১০ শতাংশ জনসংখ্যাকে টিকাদান শেষে এই টিকা দেওয়া হবে ১১ থেকে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ এই ধাপেও ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মাঝে টিকাদান কর্মসূচি চলবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ধাপেই টিকা দেওয়া হবে দেশের ৫৫ বছর ও এর অধিক বয়স্ক জনসংখ্যাকে। ৫৫ বছরের বেশি বয়সী, যাদের মাঝে নানারকম গুরুতর রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে তারা এই ধাপে টিকা পাবেন। দেশে ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সসীমার জনসংখ্যা আনুমানিক ৬৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৭ হতে পারে যা মোট জনসংখ্যার ৩.৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৭ জনকে এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। তবে প্রথম পর্যায়ে ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তারা এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে যদি ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক কেউ প্রথম পর্যায়ে টিকা না পেয়ে থাকেন তাদের এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, হূদরোগ, মুটিয়ে যাওয়াসহ অন্যান্য নানা ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্তদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এই ধাপে ৩০ লাখ ২১ হাজার ৯৩৬ জনকে টিকা দেওয়া হবে।
খসড়া পরিকল্পনায় অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৪০ থেকে ৫৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা হতে পারে দুই কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ৯ শতাংশ কো-মর্বিডিটি বা অন্যান্য রোগে ভোগার সম্ভাবনা আছে। একই সময় দেশে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী জনসংখ্যা হতে পারে এক কোটি ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার। যার মধ্যে ৭.৪ শতাংশ অর্থাৎ ৯ লাখ ৭০ হাজার ৬০ জনের কো-মর্বিডিটি থাকতে পারে।
মূলত বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত যাদের মাঝে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকে তাদের টিকা দেওয়া হবে এই ধাপে। তবে এর মধ্যে ৪০ শতাংশ অন্যান্য পর্যায়ের ধাপেও টিকা পেয়ে যেতে পারে বলে উল্লেখ করে হয়েছে খসড়া পরিকল্পনায়।
সংক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। সর্বমোট ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩ জনকে এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে।
যদিও খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, এই ধাপেরও অনেকে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বয়সসীমার মাঝে থাকলে টিকা পেয়ে যেতে পারেন।
প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে যেসব মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও গণমাধ্যমকর্মী টিকা পাননি তারা এই ধাপে টিকা পাবেন। এক্ষেত্রে ৫০ হাজার জনকে টিকা দেওয়া হবে।
দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করা জনসংখ্যাকে এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ১০ লাখ ১১ হাজার ২২৮ জনকে টিকা দেওয়া হবে।
দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ১২ লাখ জনসংখ্যাকে এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ১.১ শতাংশ অন্যান্য পর্যায়ে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও উল্লেখ করে হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন গণপরিবহন কর্মীদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে পাঁচ লাখ জনসংখ্যা টিকার আওতায় আসবে।
দেশের বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ফার্মেসিতে কাজ করা কর্মীদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে দুই লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দেশের অর্থনীতি মূলচালিকা শক্তি গার্মেন্টস খাতে কাজ করা বিভিন্ন পোশাকর্মীদের এই ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ৩৬ লাখ পোশাককর্মীকে টিকা দেওয়া হবে।
খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে ৩ লাখ টিকা।
ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের টিকা বিতরণ শেষে তৃতীয় পর্যায়ে টিকা পাবেন দেশের মোট জনসংখ্যার ২১ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জন। চতুর্থ ও সর্বশেষ পর্যায়ে দেশের মোট ৪১ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকার আওতায় আনা হবে।
হার্ড ইমিউনিটির (গণরোগ প্রতিরোধক্ষমতা) কারণে বাকি ২০ শতাংশ মানুষের টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নাও হেতে পারে বলে উল্লেখ করেন ডা. মোশতাক হোসেন। তিনি বলেন, করোনার টিকাদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত কিছু কমিটি কাজ শুরু করেছে। এই কমিটির অন্যতম কাজই হবে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করা।
ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। টিকা আসার বিষয় কনফার্ম হলে জেলা উপজেলা পর্যায়েও তালিকা করা হবে। এক্ষেত্রে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার করে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের রেজিস্ট্রশন করানো হবে।
এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন কার্ড দেখে বয়স অনুযায়ী এইসব কাজে সাহায্য করবে। শহরের ক্ষেত্রে মিউনিসিপালটি, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার কর্মীরা এ কাজে সাহায্য করবে। আগে থেকে তালিকা করলে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। তাই যখন নিশ্চিত হওয়া যাবে তখন এই কাজ শুরু করা হবে। আমরা যখন নিশ্চিত হবো টিকা আসার বিষয়ে সেখানে থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগবে টিকা দেওয়ার জন্য।
এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা কাজ করছেন তারাও টিকা পরিকল্পনার আওতায় আসবেন। তবে রোহিঙ্গাদের টিকাদানের বিষয়ে সরকার দাতাসংস্থার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারে বলে জানান ডা. মোশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, পুরো বিষয় তদারকির সুবিধার্থে একটি মোবাইল বা ওয়েবভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের সঙ্গে সমন্বিত থাকবে। এই প্ল্যাটফর্মের জনসাধারণের ব্যবহার্য অংশটি হবে মোবাইল ফোনভিত্তিক। যারা এটি ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাদের স্থানীয় পর্যায় থেকে সহায়তা করা হবে।
এরই মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ নির্মাতা অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত তিন কোটি ডোজ করোনা টিকা সংগ্রহের জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সই করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে এই ভ্যাকসিন নিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার। প্রত্যেককে এই ভ্যাকসিনের দুটি করে ডোজ নিতে হবে। প্রথম ডোজ নেওয়ার ২৮ দিন পর নিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী ছয় মাসে ৫০ লাখ করে মোট তিন কোটি ভ্যাকসিন পাওয়া আশা করছে বাংলাদেশ। আর এজন্য নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের প্রস্তুতি। দেশে টিকা আনা, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা নিয়েও নেওয়া হচ্ছে নানারকম পদক্ষেপ। সরকারের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্স ইতোমধ্যেই টিকা দেওয়ার জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মনিটরিং কমিটি গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
টিকা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা মেনে টিকা বিতরণ বিষয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।
এছাড়াও ভ্যাকসিন দেশে আনার পর সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বিতরণের আগ পর্যন্ত যত ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ আছে সেগুলো নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা এফডিএ’র অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দ্রুত টিকা সংগ্রহ করে বিতরণ করতে পারি।
দেশে কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র। এর মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে উপদেষ্টা করে গঠন করা হয়েছে কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ।
এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি।
ডিজিএ/এমডিজেএম